Biloy Mrong

Biloy Mrong

Friday, March 23, 2018

ভালোবাসার অন্তরালে তুমি, Short Story/ বাংলা গল্প/ ছোট গল্প বাংলা


                                                         বিলয় বি ম্রং


রান্না ঘর থেকে বিভিন্ন ধরণের রান্নার গন্ধ আসছে। মাছ ভাজা, মাংসের ভুনা ইত‌্যাদি অনেক রকমের রান্না। এমনই এক সুগন্ধীময় পরিবেশে সারাদিনের কর্মক্লান্তির শরীর ও মন নিয়ে বিশাল দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিংবেল বাজাল। কিছুক্ষণ হলো পৃথিবীর দিবাকর বিদায় নিয়েছে। সন্ধ‌্যা শেষ  রাত ঘনিয়ে আসছে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কর্মব‌্যস্ত সকল মানুষ নিজ নিজ বাসায় ফিরছে। কিন্তু বিশাল বাসায় ফিরে প্রতিদিনই কিছুটা দেরি করে। রাত নয়টার আগে সে কখনও বাসায় ফিরে না। তখন মাত্র রাত আটটা বাজে। তাই এ সময়ে হঠৎ কলিংবেল বেজে উঠতেই বিথী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, এই অসময়ে আবার কে এলো!! তারপর দরজা খুলে দিয়ে সে আবার আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল- আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে ? এই কথা বলার পর উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। কারণ তখন সে বিশালের প্রিয় খাবার মাছ ভাজছিল। বিথীর এভাবে চলে যাওয়াতে বিশালের মনে কোন ধরণের প্রতিক্রিয় হলো না। কারণ সে প্রবেশ করা মাত্রই মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছিল। তাই সেও বিথীকে অনুসরণ করে রান্না ঘরের দিকে গেল। বিশালকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিথী বলল, তুমি আবার এখানে এলে কেন? বিশাল মিষ্টি হেসে বলল- সব কেন এর উত্তর হয় না। ভালো লাগলো তাই চলে এলাম। বিথীর দীঘল কালো চুলে হাত দিতে দিতে বিশাল বলল- আজ তোমার মন অনেক ভালো আছে মনে হচ্ছে?  তখন  বিথী কেমন যেন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ এই প্রশ্ন? অমাকে কী আজ মন খারাপের মত দেখা যাচ্ছে ? বিশাল বলল, না, তেমন ভাবে দেখা যাচ্ছে না; তবুও জিজ্ঞস করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম তোমার মনটা সত‌্যিই আজ ভালো আছে কি না। 
রবীন্দ্রনাথ তার শেষের কবিতায় লিখেছেন--

এরকম যদি তোমার বেলাতেও হয় তাহলে স্বামী হিসেবে আমিও ব‌্যর্থ হয়ে যাবো। আর এ ছাড়াও যে দিন তোমার মন খারাপ থাকে সে দিন আমার দিনটাও ভালো কাটে না। যাই হোক আজ তোমার মনটা খুব ভালো দেখাচ্ছে। তাই আজ দুষ্টুমিটাও জমবে বলে মনে হচ্ছে----ঠিক নয় কী? তখন বিথী সত‌্যিইকারের দক্ষ গৃহিনীর মতো কোমরে আচল পেচিয়ে বিশালের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুর নিয়ে বলল, এই তোমার উদ্দেশ‌্যটা কি, বলতো? আমার কোন উদ্দেশ‌্য নেই, বলতে বলতেই সে বিথীর মুখের উপর চলে আসা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিল। তারপর নাকে হালকা টান দিয়ে বলল- আমি সারা জীবন তোমার এই চাঁদমাখা হাসি দেখতে চাই। তখন বিথী আবেগ তাড়িত হয়ে বিশালকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বিশালের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, তুমি সারা জীবন আমাকে এভাবেই তোমার বাহুডোরে আগলে রেখো তাহলেই আমি সুখি হবো। বিশাল বিথীকে ছাড়িয়ে তার চিবুক ধরে বলল-তুমি আমাকে এত ভালোবাস কেন? দেখ, তোমার ছোট বোন বন‌্যা এক প্রবাসীকে বিয়ে করে কত সুখে আছে। আমার সাথে বিয়ে না হয়ে যদি অন‌্য কারো সাথে বিয়ে হতো তাহলে তুমি আরোও অনেক সুখি হতে পারতে। দেখ, তাদের গাড়ি আছে, বাড়ি আছে আরো অনেক কিছু আছে। কিন্ত ‍আমার কি আছে কিছুই নেই। ছোট একটা চাকুরী করে সংসার চালাচ্ছি। আর থাকছি ছোট একটা বাসা বাড়িতে। বিশালের কথা শুনে বিথী মলিন হাসি দিয়ে বলল- তুমি যদি একজন মেয়ে হতে তাহলে বুঝতে পারতে বন‌্যা এখন কেমন আছে। আমি মানছি বন‌্যার সব আছে, কিন্তু নারী হিসেবে তার যে কিছু চাওয়া পাওয়ার ছিল তার থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে। 
তার--- মানে?
মানেটা একটাই- বিয়ে করার পর তার স্বামী দেশে মাত্র দুই সপ্তাহ ছিল, তারপর আবার বিদেশে চলে গেল। তিন বছর পর পর এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসে। বিদেশ থেকে আসার পর আড্ডা বন্ধু বান্ধব করে এক মাস কাটিয়ে আবার চলে যায়। ব‌্যক্তি জীবনে সে বিবাহিতা হলেও জীবনটাকে একাই যাপন করতে হচ্ছে। এখন তুমিই বলো, বন‌্যা স্বামীকে প্রবাসে রেখে কতখানি সুখে আছে? বাড়িতে আছে শুধু তার শ্বাশুড়ী। ছেলের ভালোবাসা কী শ্বাশুড়ী দিতে পারবে? শুধু টাকা-পয়সা থাকলেই কি মানুষ সুখী হয়? যখন দু্‌টি আত্মা, দুটি মন মিলে মিশে থাকে তখনই মানুষ সুখী হয়। আমার ওই সবের দরকার নেই, তোমার ভালোবাসাই আমার যথেষ্ট। 
ভালোবাসাকে সব সময় আগলে রাখলে তাতে কখনোও ভাটা পড়েনা। আমাদের ভালোবাসা চলমান থাকবে সব সময়। বিয়ে করলেই প্রেম শেষ হয়ে যায় না। তখন প্রেমকে আরো গভীর থেকে গভীরতর করতে হয়। যা বলছিলাম তুমি আমাদের সাধ‌্যের মধ‌্যে রেখে সংসারটাকে কত সুন্দর করে পরিচালনা করে যাচ্ছ। এত কিছু করার পর তোমার ক্লান্তি আসেনা ?
তখন বিথী বলল- ভালোবাসায় কী কোন ক্লান্তি আছে? ভালোবাসা চির অম্লান। বিথীর মুখে এ কথা শুনার পর বিশাল বলল, কথায় বলে- যে মেয়ে  ভালো রান্না করতে জানে সে নাকি ভাল প্রেমিকাও হতে পারে! আর যে মেয়ে ভালো রান্না করতে জানে না সে নাকী ভালো প্রেমিকাও হতে পারে না। তোমার হাতের রান্না যেন ঠিক আমার মায়ের হাতের রান্নার মতোই। হয়েছে হয়েছে আর গুণগান গাইতে হবেনা। এখন যাও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো আমি কফি দিচ্ছি। 
রাতের খাবার অনেক আগেই শেষ হয়েছে। রাত যত গভীর হচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা ততই বাড়ছে। শুধু মাঝে মাঝে বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শুনা যাচ্ছে। এছাড়া তাদের দুজনের কথা বলার শব্দ ছাড়া আর তেমন কোন শব্দ তাদের কানে আসছে না। এমনই এক আধ‌্যাত্ম ও ধ‌্যানমগ্ন পরিবেশে যখন তারা দুজনে ঘুমাতে যাবে তখন ছোট একটি কাজকে কেন্দ্র করে তাদের দুজনের মধ‌্যে দেখা দিল মনোমালিন‌্য। বিভেদটা হয়েছিলো মশারী টানানো নিয়ে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে সব সময় বিশালই মশারী টানাতো। কিন্তু ক্লান্ত বিশাল আজ না টানিয়েই বিছানাই শুয়ে পড়েছে। তাই অনুন্বয়ের সুরে সে বিথীকে বলল, আজ তুমি মশারীটা টানিয়ে দিও। ইতোমধ‌্যে বিথীও তার পাশে শুয়ে পড়েছিল। তাই সে সাথে সাথে বলল আমি টানাতে পারবনা না। এ কথা শুনে বিশাল কিছুটা রেগে গিয়ে বলল- টানাতে না পারলে এখানে ঘুমিওনা। স্বামীর কাছ থেকে এমন অপ্রত‌্যাশিত কথা শুনে বিথী নীরবে বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে চলে গেল। রাগ ও অভিমানে কখন যে তার দুচোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল সে তা খেয়ালই করেনি। এভাবে অনেকক্ষণ একা বসে থাকলো সে। তার বিশ্বাস ছিলো বিশাল তাকে আদর করে এখান থেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে আর আসলো না তাই কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো । বিথী ভাবতে লাগল, যে মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন সুখে থাকবো বলে ঘর বাধলাম সেই কি না আজ আমার সাথে এমন ব‌্যবহার করল! এদিকে মশার উৎপাত আর শীতের জন‌্য বেশীক্ষণ বসেও থাকতে পারছে না। অবশেষে আরও কিছুক্ষণ থাকার পর সে বাধ‌্য হলো তাদের বেড রুমের দিকে যেতে। যখন সে রুমের ভিতর ঢুকলো তখন আশ্চর্য হয়ে গেল। মশারী টানানো। বিশাল মনের সুখে ঘুমাছে আর এদিকে তার বিথী একা একা কষ্ট পাচ্ছে। একটু আগে মাত্র বিথীর সাথে তার যে ঘটনা ঘটে গেল এটা যেন তার মনেই নেই। যেন বিছানার উপর একজন নিষ্পাপ শিশু ঘুমিয়ে আছে। এতক্ষণ পর বিথী নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেই লজ্জা পেল। আসলে স্বামীর সাথে তার এমন আচরণ করা একদমই উচিত হয়নি। তারপর মশারীর ভিতরে ঢুকে বিশালকে হালকা ঠেলা দিয়ে বলল-এই শুনছো, একটু সরে ঘুমাও, আমার জন‌্য জায়গা হচ্ছে না। তখন আধো জেগে বলল-
তুমি এখনও ঘুমাওনি? একথা শুনে বিথীর মাথায় যেন আর একবার আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যে কিনা একটু আগে  তার সাথে রাগ করল, সেই এখন কত শান্ত হয়ে গেল! স্বামীর এমন বন্ধুভাবাপন্ন ও সরল আচরণ দেখে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সব রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই তুমি এত ভাল কেন? তারপর বিলাশের বুকে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
h

0 Post a Comment: