ভার্সিটি জীবনের প্রথম দিনের ক্লাশ শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিবো তখন মনে হলো একবার বুলিটিন বোর্ডটা দেখেই যাই, যদি কোন জুরুরী নোটিশ থাকে। একা দাঁড়িয়ে চোখ বুলাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ একটা মেয়ে খট্ খট্ শব্দে আমার দিকে এগিয়ে এলো। খুব দ্রুত এসে আমার পেছনে দাঁড়ালো এবং ওভাবেই সেও বোর্ড দেখছিলো। যেহেতু সে আমার ঠিক পেছনে ছিলো তাই তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের উষ্ণ বাতাস আমার ঘার এবং ডান কান আলতো ভাবে স্পর্শ করছিলো। আমি একবার পিছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে একটু সরে দাঁড়ালাম। তারপর সে বোর্ডের আরও কাছে চোখ নিয়ে কি যেন দেখে আগের ভঙ্গিমায় খট্ খট্ শব্দ করে গেটের বাইরে চলে গেল। আমিও ধীর পায়ে বাইরে চলে আসি এবং হাটতে হাটতে বাসের টিকিট কাউন্টারে চলে আসলাম। টিকিট কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় হঠাৎ দেখলাম সেই মেয়েটি আরো দু’জন বান্ধবী নিয়ে কথা বলতে বলতে আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে সময় আমার বাসটিও চলে আসে। বাসের উঠার পর জানালা দিয়ে আমি আবার তাদের দেখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ততক্ষণে তারা ব্যস্তময় শহরে হাজার মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেছে। বাসায় ফিরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে প্রতিদিনের ন্যায় ছাত্র পড়াতে চলে গেলাম।
রাতের আকাশটা আজ কেমন যেন ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে। চাঁদ নেই তবে তারার মেলা আছে। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর দেখতে চেষ্টা করলাম। রাস্তায় এখনও দু’একটা গাড়ি রাতের ফাঁকা রাস্তা পেয়ে খুব দ্রুত বেগে ছুটে যাচ্ছে। আমাদের বাসার প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে হয় আমি একাই জেগে আছি। অন্য দিন হলে আমিও ঘুমিয়ে পড়তাম। কারণ রাত জাগার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু আজ কেন যেন আমার চোখে ঘুম একদমই আসছেনা। তাই দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ পাশের ফ্ল্যাটের জানালার দিকে গেল। তাকিয়ে দেখে অবাক হলাম! একটা ষোড়শী সুন্দরী মেয়ে জানালার গ্রীল ধরে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার চোখ তার চোখে পড়তেই সে লজ্জায় লাল হয়ে সেখান থেকে সরে গেল। তার লজ্জামাখা মুখশ্রীটা দেখে আমি মনে মনে হাসলাম। এর আগে তাকে কখনও দেখিনি। হয়তো এখানে তারা নতুন এসেছে। তাকে দেখার পর আমার চোখে ভাসতে লাগলো সেই মেয়ের মুখছবি। অবশেষে মেয়েটির কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
পরদিন সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙ্গলো আমার, তখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। নাস্তা করেই ভার্সিটির দিকে ছুটে গেলাম। ভার্সিটিতে পৌঁছার দশ মিনিট পর ক্লাশের ঘন্টা বাজলো। ক্লাশে বসে আছি এমন সময় হঠাৎ একটি মেয়ে আমার পাশে এসে বসলো। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন ম্যাডাম ক্লাশে ঢুকলো। ম্যাডাম বয়স্ক হলেও উনাকে দেখে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ এর মতো লাগছিলো। ইংলিশ কবি লর্ড বায়রনের লেখা কবিতা “ She walks in Beauty" এর মহিলার মতো তারকা খচিত শাড়ী পড়ে আসছিলো। সেই সাথে অন্যান্য সাজ তো ছিলোই। উনার প্রথম ক্লাশ তাই সেদিন ম্যাডাম শুধু উপদেশ বাণী শুনালেন। তিনি বললেন, “তোমাদের জন্য আমার উপদেশ হলো- যখন তোমরা কোন কাজ করতে যাবে তখন আগেই চিন্তা করে নিবে কাজটা তোমার এবং অন্যের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে কিনা। তেমনি কাউকে কিছু বলতে গেলে আগেই ভেবে নিবে তোমার বাক্যবানে কারোর কোন ক্ষতি, কষ্ট বা দুঃখ পাচ্ছে কিনা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কারোর বিনাশ করতে নয় বরং অপরের মঙ্গল সাধন করতে ও সবাইকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে। মনে রেখো- আত্নসংযম ও বিশুদ্ধতাই জীবনের পূর্ণ আনন্দ আনে। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে আনন্দ থাকেনা এবং যেখানে আত্নসংযম নেই সেখানে বিশুদ্ধাতার কথা চিন্তাই করা যায়না।” প্রথম ক্লাশেই ম্যাডামের প্রতিটা বাক্য হৃদয়ে গেথে রেখেছিলাম।
সেদিন ক্লাশেই আমি মেয়েটিকে খুব ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম। দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ মেয়ে নয় সে। ভাবসাব দেখে বুঝা যায় বাবার কিছু আছে। এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। কিন্তু তার সাথে চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি একবারও। একদিন টিফিন পিরিয়ডে লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছিলাম। তখন ছোট একটি কাশির শব্দে আমার মনোযোগ স্থিতিমিত হলো। তাকিয়ে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। কিছুক্ষণ মনে হয় স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মন ও দৃষ্টির ঘোর ভেঙ্গে দিয়ে মেয়েটি বললো-
-আমি কি এখানে বসতে পারি?
তারপর সে আমার সাথে বসে অনেক্ষণ গল্প করেছিলো। এভাবে প্রতিদিন আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা চললো। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে উঠে যা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসায় রূপ নেয়। একাধারে সে আমার খুব ভালো বন্ধু, প্রেমিকা এবং সহপাঠি। আমাদের বন্ধুত্ব এবং পড়াশুনা দুটোই খুব ভালোভাবে চলছিলো। কিন্তু একদিন লক্ষ্য করলাম সে ক্লাশে আসেনি। কোনদিন কোন অসুবিধা হলে সে আমাকে জানাত; কিন্তু সেদিন সে ফোন পর্যন্তও করেনি। আমি নিজে তাকে অনেকবার কল করেও পাইনি। আমি এতক্ষণ যার কথা বলছি তার নাম এখনো বলাই হলো না। হ্যাঁ বলছি- তার নাম মেঘলা। সেই মেঘলা পরদিনও যখন আসলো না তখন আমার অনেক চিন্তা হলো। কে যেন আমার কানে বার বার বলছিলো তোমার মেঘলা বিপদে আছে। এভাবে এক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মেঘলা যদি আমার সাথে প্রতারণা করে তবুও আমি তার সাথে শেষ দেখা ও কথা বলে আসবো।
শ্রাবণের অপরাহ্ন! নীলাকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির আগেই আমি মেঘলার বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম। পৌঁছেই শুনতে পেলাম মেঘলা সাতদিন যাবত অসুস্থ এবং আজকে তাকে বাসায় আনা হয়েছে। তারপর ধীর পায়ে আমি মেঘলার রুমে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে দেখে সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেল। তার দু’চোখ বন্ধ। কয়েকটি এলোমেলো চুল তার মুখের উপর পড়ে আছে। আমি হাল্কা স্পর্শ করে তার মুখের চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার হাতের মৃদু স্পর্শেই সে কেমন যেন শিহরিত হলো এবং চোখ বন্ধ করেই সে তার কোমল হাত দিয়ে আমার হাত ধরে ফেললো। তারপর চোখ খুলে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চাহনিতে এমন ছিলো যেন সে আমাকে হাজার বছর পর দেখছে।
তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার দুইটি লাইন মনে পড়ে গেলো।
“বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতোন চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
তারপর এই সাতদিনে দু’জনের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে বলতে কখন অনেক সময় পার হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। যখন ঘড়িতে রাত আটটা তখন মেঘলাকে কোন মতে বুঝিয়ে আবার সকাল বেলাতেই আসব বলে চলে আসতে যাচ্ছি তখন তার দু’চোখে আবার জলে ভরে গেলো। কিছু বলার জন্য তার ঠোঁট কাঁপছে অথচ কিছু বলছেনা। তাই আমি তার চোখের জল মুছে দিয়ে একটি হাত ধরে বললাম-
-মেঘলা, তুমি কি কিছু বলবে?
-সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তারপর সে আমার মুখের কাছে তার ঠোঁট এনে আলতো ভাবে আমার ঠোঁটে চুমো এঁকে দিয়ে ক্ষীণস্বরে বলল-
-যতটা তোমাকে ভালোবেসেছিলাম ততখানি ভালোবাসা দিতে পারিনি তোমাকে। ভালো থেকো।
এটাই ছিলো আমাদের দু’জনের ভালোবাসার প্রথম এবং শেষ চুমো উপহার। শেষ বাক্যটি বলার পর সে এক দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চোখে ঘুম নেই। শুধু প্রহর গুনছি কখন ভোরের আলো ফুটবে আর আমি মেঘলার কাছে ছুটে যাবো। এমন সময় হঠাৎ আমার চোখ পাশের ফ্ল্যাটের জানালায় চলে গেলো। দেখলাম ছায়ামূর্তির মতো কে যেন আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে। পরে বুঝতে পারলাম এটা সেই ষোড়ষী মেয়েটি যাকে একবার এই এখানেই দেখেছিলাম। আজ তার সাথে চোখাচোখি হওয়ার পরেও লজ্জায় লাল হয়ে পালিয়ে যায়নি মেয়েটি। বরং আমিই সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কারণ এখন মেঘলাকে ছাড়া আমি আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চাইনা। অবশেষে ভোরের আলো ফুটলো। বাইরে আজ পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ নেই। তার পরিবর্তে একটি পাখি খুব করুণ স্বরে ডাকছে। মনটাও কেমন যেন অনুভূত হলো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি গুড়ি গুড়ি পড়ছে। তবুও আমাকে যেতেই হবে। পথে ফুলের দোকান থেকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনে নিলাম। আমি তা হাতে নিয়ে যতই মেঘলার বাড়ির দিকে যাচ্ছি ততই আমার মন কেমন যেন করছে। যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম তখন বুঝতে বাকি রইলো না। আমি ধীর পায়ে মেঘলার রুমে প্রবেশ করলাম। তাকে খাট থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মেঘলাকে দেখে মনে হলো চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আমি যখন তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছি সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেলো, একদিন সে দুষ্টামি করে বলেছিলো।
কথাটি মনে পড়তেই আমার দু’চোখ হতে ঝর্ণা ধারার মতো জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।